খুশকি কি? কারণ, উপসর্গ, জটিলতা ও চিকিৎসা
খুশকি ত্বকের বিশেষ একটি অবস্থাকে বুঝায়, যা মূলত মাথার খুলিতে বেশী দেখা যায়। এতে চর্মরেণু মাথার ত্বক থেকে আঁশের মত উঠে উঠে আসে, এবং ঝরে পড়ে। খুশকি আত্মসম্মানের এমনকি সামাজিক সমস্যাও তৈরী করতে পারে। এ অবস্থার আরও ভয়াবহ রূপ হলো সেবোরেইক ডারমাটাইটিস বা ত্বকের তৈলাক্ত ও চুলকানিপ্রবণ অবস্থা।
খুশকি আমাদের শরীরের অন্যতম একটি সমস্যা। খুশকি হলে মাথায় প্রচণ্ড চুলকানি সহ নিয়মিত চুল পড়তে পারে। মাথার ত্বক বা স্কাল্পে এক ধরণের ফাঙ্গাস অতিরিক্ত হওয়ার কারণে এটি হয়ে থাকে। চলুন জেনে নিই খুশকি হওয়ার কারণ, প্রতিকার ও প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে।
খুশকির স্পষ্ট কোন কারণ জানা না গেলেও, ধারণা করা হয় জিনগত ও পরিবেশগত কারণে খুশকি হতে পারে। শীতকালে যেটা আরও বাড়ার সম্ভাবনা থাকে।খুশকির পেছনে কারণ হিশেবে অপরিচ্ছন্নতাকে দায়ী করা হলেও, মূলত তার সাথে এর সম্পর্ক নেই। ত্বকের কোষের মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে খুশকি হয়ে থাকে। লক্ষণের উপর ভিত্তি করে খুশকির রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা করা হয়।
মাথার ত্বক বা স্কাল্পে একটা সাধারণ চক্র হিসাবে সবসময় কিছু নতুন কোষ উৎপন্য হয় ও কিছু পুরনো কোষ ঝরে যায়। তবে যদি পুরনো মরা কোষ জমে যায় এবং সাদা আঁশের মতো গুঁড়া পড়তে থাকে এবং চুলকানি হয় যাকে আমরা খুশকি বলে থাকি। স্ক্যাল্পের শুষ্ক চামড়া যা ম্যালেসেজিয়া নামক এক ধরণের ফাঙ্গাস অতিরিক্ত হওয়ার কারণেই খুশকি হয়ে থাকে। চলুন বিস্তারিত জেনে নিই মাথায় খুশকি হওয়ার কারণ, প্রতিকার ও প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে।
খুশকির কোন সাধারন প্রতিকার নেই। অ্যান্টিফাংগাল ক্রিম বা স্যালিসিলিক অ্যাসিড ব্যবহার করে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হতে পারে। প্রাপ্তবয়স্কদের অর্ধেকই এ অবস্থার স্বীকার, যেখানে মহিলাদের চেয়ে পুরুষদের মধ্যে আক্রান্তর হার বেশী। পৃথিবীর প্রায় সব জায়গার লোকই খুশকিতে আক্রান্ত হয়।
কারণ
অনেক কারণেই খুশকি হতে পারে। খুশকির সবচেয়ে সাধারণ কারণ বলা যেতে পারে সেবোরেইক ডারমাটাইটিস বা ত্বকের তৈলাক্ত ও চুলকানিপ্রবণ অবস্থাকে।
এক ধরনের ছত্রাক আছে যার নাম মেলাসেজিয়া। সব প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মাথার খুলিতেই এই মেলাসেজিয়া ছত্রাক থাকে। মেলাসেজিয়া নতুন ত্বক কোষ জন্মাতে সহায়তা করে। কিন্তু ত্বকে ময়লা জমে তেল চিটচিটে অবস্থার মধ্যে এই ছত্রাক বিপদে ফেলতে পারে। এ অবস্থায় জন্মানো অতিরিক্ত ত্বক কোষগুলো মরে যায় এবং ঝরে পড়ে। মাথা থেকে ঝরে পড়া সাদা-হলদে খুশকি আসলে আমাদের ত্বকের মৃত কোষ। তবে, মাথা ছাড়াও বাহুমূল, ঊরুসন্ধিসহ শরীরের অন্যত্রও খুশকি হতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে খুশকি কোনো রোগ বা রোগের লক্ষণ নয়। মাথার লোমকূপে ময়লা জমে এবং ছত্রাকের প্রভাবে সাধারণত খুশকি হয়ে থাকে। নিম্নে খুশকি তৈরি হওয়ার কিছু অবস্থা বর্ণনা করা হলো।
১। শুষ্ক ত্বক
শীতের সময় আবহাওয়ায় আর্দ্রতা কমে যাওয়ার ফলে দেহের ত্বকের পাশাপাশি মাথার ত্বকও শুষ্ক হয়ে যাওয়ার কারণে খুশকি বেশী হয়ে থাকে। এছাড়া এসময় বাইরের ঠান্ডা বাতাস ও ঘরের তুলনামূলক গরম বাতাসের ফলে তাপমাত্রার যে অসামাঞ্জস্যতা দেখা যায় সে কারণেও খুশকি হতে পারে।
২। চুল যথেষ্ট পরিমাণে না আঁচড়ানো
চুল যথেষ্ট পরিমাণে না আঁচড়ালেও খুশকি হতে পারে। যদি চুল কম আঁচড়ানো হয় তাহলে মাথার ত্বকের চামড়ার ঝরে যাওয়ার প্রবণতা অনেক কমে যায়। ফলে মাথায় খুশকির সৃষ্টি হয়।
৩। মাথায় অতিরিক্ত তৈল ব্যাবহার
যারা মাথায় অতিরিক্ত তৈল ব্যবহার করে তাদের খুশকির সংক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। অতিরিক্ত ব্যবহার করা তেল স্তুপ আকারে চুলের গোড়ায় জমা হয়ে পরবর্তীতে সেখানে ছত্রাকের প্রাদুর্ভাব ঘটে যার ফলে মাথায় খুশকির পরিমান বেড়ে যায়।
৪। শ্বেত প্রদর জাতীয় অসুখে আক্রান্ত হলে
ঈস্ট জাতীয় ( শ্বেত প্রদর জাতীয় ) অসুখ বা এলার্জির সমস্যা আছে এরুপ ব্যক্তিদের খুশকির প্রবণতা বেশী লক্ষ্য করা যায়। মহিলাদের এ সমস্যা বেশী পরিলক্ষিত হয়। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি ও ঈস্ট কাউন্টারএক্ট করে ও খুশকি হওয়ার প্রবণতাকে বাড়িয়ে তোলে।
৫। পর্যাপ্ত পরিমাণে শ্যাম্পু না করা
যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে শ্যাম্পু না করা হয় তাহলে মাথার ত্বক অপরিষ্কার থাকে। এর ফলেও মাথায় খুশকির উৎপত্তি হতে পারে।
৬। সঠিক খাদ্যাভাসের অভাব
সঠিক খাদ্যাভাসের অভাবও খুশকির অন্যতম কারণ। যদি গৃহীত খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন বি ও জিংক না থাকে তাহলেও খুশকি হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়া অধিক পরিমাণে চর্বি জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করলেও খুশকি হতে পারে।
৭। ম্যালেসেজিয়া নামক ফাঙ্গাসের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া
সকলের স্ক্যাল্পেই ম্যালেসেজিয়া নামক এক ধরণের ফাঙ্গাস অল্প পরিমাণে থাকে এবং তেমন কোন সমস্যার সৃষ্টি করে না। তবে মাথার ত্বকে ফাঙ্গাসটির পরিমাণ অতিরিক্ত বেড়ে গেলে তা ত্বকের ক্ষরিত তেল শোষণ করে নেয়। এর ফলে স্ক্যাল্প অতিরিক্ত ত্বকীয় কোষ উৎপাদন করে থাকে। এ সকল অতিরিক্ত কোষ মৃত হলে স্ক্যাল্প ও চুলের তেলের সাথে মিশে খুশকির সৃষ্টি করে।
৮। অতিরিক্ত মানসিক চাপ
অতিরিক্ত মানসিক চাপও খুশকির একটি অন্যতম কারণ। যারা অতিরিক্ত চাপের মধ্যে থাকেন তাদের খুশকি হওয়ার প্রবণতা বেশি পরিলক্ষিত হয়।
৯। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া
যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের খুশকি বেশি হয়ে থাকে। এছাড়া বিশেষ কিছু রোগ যেমন- পারকিন্সন ডিসিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক, সেন্সিটিভ ত্বক ও ত্বকের সমস্যা (সোরিয়াসিস, একজিমা) ইত্যাদি যাদের রয়েছে তাদেরও খুশকির প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়। কিছুদিন আগের একটি গবেষণায় পাওয়া যায় যে ১০.৬% মানুষ যাদের এইচ.আই.ভি আছে তাদের খুশকির সমস্যা বেশি হয়ে থাকে।
১০। পানির সমস্যার কারণে
অনেকসময় পানির সমস্যার কারণেও খুশকি হতে পারে। যদি পানিতে ক্লোরিনের পরিমাণ বেশি থাকে তাহলে ত্বক তাড়াতাড়ি শুষ্ক হয়ে যায় যা মাথায় খুশকির কারণ হয়ে ওঠতে পারে।
প্রতিরোধে করনীয়:
১। শ্যাম্পু ব্যবহার
যাঁদের প্রায়ই খুশকি হয় তাঁরা নিয়মিত চুলে পরিমিত শ্যাম্পু ব্যবহার করতে পারেন।
২। মাথায় স্কার্ফ ব্যবহার
বাইরে বের হলে ধুলোবালি মাথায় জমে খুশকির প্রাদুর্ভাব বাড়িয়ে তোলে। তাই এই সমস্যা দূর করতে মাথায় স্কার্ফ বা ওড়না ব্যবহার করা যেতে পারে।
৩। খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন
চুলের খুশকি নিয়ন্ত্রণে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন একটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। এজন্য মাথার ত্বক ভালো রাখতে প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি খাওয়া সহ চর্বিজাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে।
৪। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
খুশকিমুক্ত চুলের জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা খুবই গুরুত্বপুর্ণ। চুল অপরিষ্কার থাকলেই খুশকি বেশি হয়। তাই নিয়মিত চূল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
৫। ভেজা চূল জলদি শুকিয়ে নেওয়া
ভেজা অবস্থায় চুল বেঁধে রাখা ঠিক নয়। এজন্য গোছলের পর যত দ্রুত সম্ভব চুল ভালো করে মুছে নিতে হবে। প্রয়োজনে ধীরে ধীরে মোটা দাঁতের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে নিতে হবে। এছাড়া চুল শুকানোর জন্য হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার না করে ফ্যানের বাতাসে শুকিয়ে নেওয়া ভালো।
খুশকি হলে দ্রুত তার প্রতিকার করা দরকার। নইলে এই সমস্যা থেকে চুলপড়াসহ নানা সমস্যা তৈরি হতে পারে। তাই খুশকি প্রতিরোধে শ্যম্পু ব্যবহারের পাশাপাশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা ও খাবারের বিষয়েও সমান মনযোগী হওয়া প্রয়োজন।