গ্লুকোমা এর কারণ, উপসর্গ, জটিলতা ও চিকিৎস

গ্লুকোমা হলো চোখের একপ্রকার রোগ যাতে অপটিক স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও চোখ অন্ধ হয়ে যায়। গ্লুকোমা অনেক প্রকারের হয় যেমন ওপেন অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা, ক্লোজড অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা, নরমাল টেনশন গ্লুকোমা অন্যতম । ওপেন অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা ধীরে ধীরে হয় ফলে চোখে ব্যথা অনুভূত হয় না। চিকিৎসা না করালে প্রথমে পার্শ্বীয় দৃষ্টি, তারপর কেন্দ্রীয় দৃষ্টি নষ্ট হয়ে অন্ধত্ব বরণ করতে হয়। ক্লোজড অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা ধীরে ধীরে বা হঠাৎ করে হতে পারে। এর লক্ষণগুলো হলো চোখে তীব্র ব্যথা, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, ঝাপসা দৃষ্টি, চোখের মণি বা তারারন্ধ্র বড়ো হয়ে যাওয়া, বমিভাব। গ্লুকোমার কারণে দৃষ্টিশক্তি কমে গেলে তা স্থায়ীভাবে কমে।

এই রোগের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে চোখের অভ্যন্তরীণ চাপ (intraocular pressure) বেড়ে যাওয়া, পরিবারের অন্য সদস্যের এই রোগ থাকা, উচ্চ রক্তচাপ, অতিস্থুলতা ইত্যাদি। ইন্ট্রাওকুলার প্রেসার ২১ মি.মি. পারদ চাপের বেশি থাকলে গ্লুকোমার আশঙ্কা বেশি। তবে চোখের চাপ স্বাভাবিক থাকলেও গ্লুকোমা হতে পারে যেমন নরমাল-টেনশন গ্লুকোমা।

রোগের প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা শুরু করলে দৃষ্টিশক্তি অটুট রাখা সম্ভব। ওষুধের মাধ্যমে চোখের চাপ স্বাভাবিক রাখা হয়।গ্লুকোমা চিকিৎসায় অনেক রকম ওষুধ রয়েছে। এছাড়া কিছুক্ষেত্রে লেজারের মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া যায়। ওষুধে ভালো না হলে বিভিন্ন সার্জিক্যাল পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ক্লোজড অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমার চিকিৎসা জরুরি ভিত্তিতে করতে হবে। সারাবিশ্বে প্রায় ৬৭ মিলিয়ন লোক গ্লুকোমায় আক্রান্ত। সাধারণত বয়স্ক লোকের বেশি হয়। ক্লোজড অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমা মহিলাদের বেশি হয়। সারাবিশ্বে ছানির পরে গ্লুকোমা অন্ধত্বের দ্বিতীয় কারণ।

গ্লুকোমা কী?

গ্লুকোমা চোখের একটি জটিল রোগ, যাতে চোখের স্নায়ু ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ধীরে ধীরে চোখের দৃষ্টি কমে যায়। এমনকি এতে একসময় রোগী অন্ধত্ববরণ করতে বাধ্য হয়। তবে সময়মতো ধৈর্য ধরে চিকিৎসা করলে এ অন্ধত্বের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চোখের অভ্যন্তরীণ উচ্চচাপ এর জন্য দায়ী।

গ্লুকোমা সম্পর্কে জানা জরুরি কেন?

১. আমাদের দেশে এবং পৃথিবীব্যাপী অন্ধত্বের দ্বিতীয় প্রধান কারণ হল চোখের গ্লুকোমা।
২. অনেক ক্ষেত্রে এ রোগের লক্ষণ রোগী বুঝতে পারার আগেই চোখের স্নায়ু অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
৩. এ রোগে দৃষ্টির পরিসীমা বা ব্যাপ্তি ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসে এবং কেন্দ্রীয় দৃষ্টিশক্তি অনেকদিন ঠিক থাকে বিধায় রোগী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে অনেক দেরি করে ফেলেন।
৪. গ্লুকোমা চোখের অনিরাময়যোগ্য অন্ধত্ব তৈরি করে। তাই একবার দৃষ্টি যতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
৫. চোখের গ্লুকোমা রোগ হলে রোগীকে সারা জীবন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়। অনেকেই শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকের সংস্পর্শে থাকেন না বা ঠিকমতো ওষুধ ব্যবহার করেন না। ফলে এ রোগ নীরবে ক্ষতি করে অন্ধত্বের দিকে নিয়ে যায়।

কেন এ রোগ হয়?

এ রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া না গেলেও অদ্যাবধি চোখের উচ্চচাপই এ রোগের প্রধান কারণ বলে ধরে নেয়া হয়। তবে স্বাভাবিক চাপেও এ রোগ হতে পারে। সাধারণত চোখের উচ্চচাপই ধীরে ধীরে চোখের স্নায়ুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং দৃষ্টিকে ব্যাহত করে। তবে কিছু কিছু রোগের সঙ্গে এ রোগের গভীর সম্পর্ক লক্ষ করা যায় এবং অন্যান্য কারণেও এ রোগ হতে পারে। যেমন-

পরিবারের অন্য কোনো নিকটাত্মীয়ের (মা, বাবা, দাদা, দাদি, নানা, নানি, চাচা, মামা, খালা, ফুপু) এ রোগ থাকা।

১. উচ্চবয়স (চল্লিশোর্ধ্ব)।
২. ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ।
৩. মাইগ্রেন নামক মাথাব্যথা।
৪. রাত্রিকালীন উচ্চরক্তচাপের ওষুধ সেবন।
৫. স্টেরোইড নামক ওষুধ দীর্ঘদিন সেবন করা।
৬. চোখের ছানি অপারেশন না করলে বা দেরি করলে।
৭. চোখের অন্যান্য রোগের কারণে।
৮. জন্মগত চোখের ত্রুটি ইত্যাদি।

এগুলোর মধ্যে শুধু চোখের উচ্চচাপই ওষুধ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, যা গ্লুকোমা রোগের প্রধান কারণ বলে মনে করা হয়।

গ্লুকোমা রোগের লক্ষণ কী?

অনেক ক্ষেত্রেই রোগী এ রোগের কোনো লক্ষণ অনুধাবন করতে পারেন না। চশমা পরিবর্তনের সময় কিংবা নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষার সময় হঠাৎ করেই চিকিৎসক এ রোগ নির্ণয় করে থাকেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিম্নের লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। যেমন-

১. ঘন ঘন চশমার গ্লাস পরিবর্তন হওয়া।
২. চোখে ঝাপসা দেখা বা আলোর চারপাশে রংধনুর মতো দেখা।
৩. ঘন ঘন মাথাব্যথা বা চোখে ব্যথা হওয়া।
৪. দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে কমে আসা বা দৃষ্টির পারিপার্শ্বিক ব্যাপ্তি কমে আসা। অনেক সময় চলতে গিয়ে দরজার পাশে বা অন্য কোনো পথচারীর গায়ে ধাক্কা লাগা।
৫. মৃদু আলোয় কাজ করলে চোখে ব্যথা অনুভূত হওয়া।
৬. ছোট ছোট বাচ্চার অথবা জন্মের পর চোখের কর্নিয়া ক্রমাগত বড় হয়ে যাওয়া বা চোখের কর্নিয়া সাদা হয়ে যাওয়া, চোখ লাল হওয়া, চোখ দিয়ে পানি পড়া ইত্যাদি।

গ্লুকোমার জন্য কাদের চক্ষু পরীক্ষা করা জরুরি?

১. যাদের পরিবারে নিকটাত্মীয়ের এ রোগ আছে।
২. চল্লিশোর্ধ্ব প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, বিশেষ করে যাদের ঘন ঘন চশমা পরিবর্তন করতে হচ্ছে।
৩. চোখে যারা মাঝে মাঝে ঝাপসা দেখেন বা ঘন ঘন চোখ ব্যথা বা লাল হওয়া অনুভব করেন।
৪. যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, মাইগ্রেন ইত্যাদি রোগ আছে।
৫. যারা চোখে দূরের জন্য মাইনাস গ্লাস ব্যবহার করেন।

গ্লুকোমা রোগের চিকিৎসা

গ্লুকোমা রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব; কিন্তু নিরাময় সম্ভব নয়। ডায়াবেটিস বা উচ্চরক্তচাপের মতো এ রোগের চিকিৎসা সারা জীবন করে যেতে হবে। এ রোগে দৃষ্টি যতটুকু হ্রাস পেয়েছে, তা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে দৃষ্টি যাতে আর কমে না যায়; তার জন্য আমাদের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।

এ রোগে প্রচলিত তিন ধরনের চিকিৎসা রয়েছে

১. ওষুধের দ্বারা চিকিৎসা
২. লেজার চিকিৎসা
৩. শৈল্য চিকিৎসা বা সার্জারি

যেহেতু চোখের উচ্চচাপ এ রোগের প্রধান কারণ; তাই ওষুধের দ্বারা চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। একটি ওষুধ দ্বারা নিয়ন্ত্রণে রাখা না গেলে একাধিক ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। তদুপরি তিন মাস অন্তর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে এ রোগের নিয়মিত কতগুলো পরীক্ষা করে দেখতে হবে- এ রোগ নিয়ন্ত্রণে আছে কি না। যেমন-

১. দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা
২. চোখের চাপ পরীক্ষা
৩. দৃষ্টিব্যাপ্তি বা ভিজুয়াল ফিল্ড পরীক্ষা
৪. চোখের নার্ভ পরীক্ষা।

এ রোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল নিয়মিত ওষুধ ব্যবহার করা এবং সময়মতো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষা ও তার পরামর্শ মেনে চলা। যেহেতু অধিকাংশ রোগীর চোখে কোনো ব্যথা হয় না, এমনকি তেমন কোনো লক্ষণ অনুভূত হয় না, তাই রোগী নিজে, এমনকি রোগীর আত্মীয়স্বজনরাও এ দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা অব্যাহত রাখেন না; ফলে অনেক রোগী অকালে অন্ধত্ববরণ করে থাকেন। ওষুধ ছাড়াও গ্লুকোমার অন্যান্য চিকিৎসা রয়েছে, যার সিদ্ধান্ত প্রয়োজনে বা সময়মতো চিকিৎসক গ্রহণ করতে পারেন। যেমন- লেজার চিকিৎসা এবং শল্য চিকিৎসা; যার দ্বারা এ রোগে চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব।

গ্লুকোমা রোগে রোগীর করণীয়

১. চিকিৎসক রোগীর চক্ষু পরীক্ষা করে তার চোখের চাপের মাত্রা নির্ণয় করে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ওষুধের মাত্রা নির্ধারণ করে দেবেন, তা নিয়মিত ব্যবহার করা।
২. দীর্ঘদিন একটি ওষুধ ব্যবহারে কার্যকারিতা কমে যেতে পারে বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে, তাই নিয়মিত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।
৩. সময়মতো চোখের বিভিন্ন পরীক্ষা (যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে) করে দেখা যে, তার গ্লুকোমা নিয়ন্ত্রণে আছে কি না।
৪. পরিবারের সবার চোখ পরীক্ষা করে গ্লুকোমা আছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া।

সর্বোপরি মনে রাখতে হবে, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা। ঠিকমতো ওষুধ ব্যবহার করে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চললে একজন গ্লুকোমা রোগী তার স্বাভাবিক দৃষ্টি নিয়ে বাকি জীবনটা সুন্দরভাবে অতিবাহিত করতে পারেন।

পরিশেষে মনে রাখবেন, গ্লুকোমা অন্ধত্বের অন্যতম প্রধান কারণ; যার কোনো প্রতিকার নেই। প্রতিরোধই একমাত্র উপায়। চল্লিশোর্ধ্ব বয়সে আপনার চক্ষু পরীক্ষা করে চোখের চাপ জেনে নিন।

চক্ষু চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হোন, আপনার বা পরিবারের কারও গ্লুকোমা আছে কি না। গ্লুকোমা প্রতিরোধ করুন, অন্ধত্বের অভিশাপ থেকে বেঁচে থাকুন। আপনার পরিবারের সবাইকে নিয়ে, সুন্দর দৃষ্টিশক্তি নিয়ে, পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগ করুন।

ডা. ইফতেখার মো. মুনির
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, গ্লুকোমা বিভাগ,
জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল।